ফাইভার আমাকে নিজের বিজনেস সাকসেসফুল করতে যা শিখিয়েছে।

ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে যাদের ইন্টারেস্ট আছে অথবা যারা অলরেডি ফ্রিল্যান্সিংয়ের সাথে ইনভলড, তারা ওয়ার্ল্ডের সবচাইতে বড় ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেস ফাইভারের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন। ফাইভার হচ্ছে এমন একটা মার্কেটপ্লেস যেখানে ফ্রিল্যান্সাররা নিজেদের স্কিল অনুযায়ী ক্লায়েন্টদের কাছে বিভিন্ন ক্যাটাগরির সার্ভিস সেল করে থাকেন। যেমনঃ গ্রাফিক ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং, ডাটা এন্ট্রি, ওয়েব ডিজাইন ইত্যাদি। বাংলাদেশের প্রচুর ফ্রিল্যান্সার ফাইভারে পার্টটাইম কাজ করে থাকেন। আবার অনেকেই রয়েছেন যারা ফুলটাইম ফাইভারে কাজ করেই একটা ভালো অংকের অ্যামাউন্ট ইনকাম করছেন।

সাধারণত একজন ফ্রিল্যান্সার যদি ফাইভারে নিজের সার্ভিস সেল করতে চান, তাহলে তাকে বিভিন্ন রকম নিয়মকানুন ফলো করতে হয়। তা না হলে সোজা বাংলায় পান থেকে চুন খসলেই অ্যাকাউন্ট রেস্ট্রিকটেড হয়ে যাওয়ার চান্স থাকে। অর্থাৎ ফাইভারে স্বাধীনভাবে কাজ করার তেমন সুযোগ নেই। যখন স্বাধীনভাবে কাজ করার কথাটা উঠলোই তখন একটা কথা না বললেই নয়, সেটা হচ্ছে নিজেরমত করে কাজ করতে কিন্তু সবাই পছন্দ করেন। একারণে নিজের সার্ভিস সেল করার জন্য শুধুমাত্র মার্কেটপ্লেসগুলোকে টার্গেট না করে অনেকেই নিজের একটা বিজনেস স্টার্ট করতে চান যেখানে তিনি তার মতো করে ক্লায়েন্টদেরকে সার্ভিস অফার কর‍তে পারবেন। 

আমি যদি আমার নিজের ব্যাপারে বলি, আমি মূলত একজন ডিজাইনার এবং মার্কেটার। বর্তমানে আমার নিজের ডিজাইন এজেন্সি রয়েছে যেখানে আমি আমার পছন্দের ক্লায়েন্টদের সাথে কাজ করি।তবে এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, আমি কিন্তু গ্রাফিক ডিজাইন শেখার পরপরই বিজনেস স্টার্ট করিনি। বরং আমি নিজের ডিজাইন এজেন্সি স্টার্ট করার আগে ফাইভারে বেশ কিছুদিন কাজ করেছি। এই মার্কেটপ্লেসটায় কাজ করতে করতে একটা বিজনেস ডেভেলপ করার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এমন কিছু বিষয় আমি শিখেছি যেগুলো পরবর্তীতে আমার বিজনেসটাকে আজকের স্যাটিসফ্যাকটরি পজিশনে নিয়ে আসতে হেল্প করেছে। 

সবাই নিশ্চয়ই এটা জানেন যে একটা বিজনেস দাঁড় করানো মোটেও ইজি নয়। বরং বিজনেসে সাকসেসফুল হতে চাইলে প্রয়োজন প্রচুর ধৈর্য্য এবং নিজের কন্টিনিউয়াস ইফোর্ট। এর সাথে বিজনেস সাকসেসফুল করার কিছু ট্যাকটিকস ও জানা থাকা দরকার। আজকের এই লেখায় আমি ফাইভার মার্কেটপ্লেস থেকে নিজের বিজনেস ডেভেলপ করার জন্য সে বিষয়গুলো শিখেছি সেগুলো সবার সাথে শেয়ার করবো। আশা করি আমার পারসোনাল এক্সপেরিয়েন্সের আলোকে করা আজকের ডিসকাশন সবার জন্য হেল্পফুল হবে। 

ফাইভারে কাজ করার সময় রিয়েলাইজ করেছিলাম  আপসেলিং বলে একটা ব্যাপার আছে যেটা ফ্রিল্যান্সারদেরকে বেশি বেশি প্রফিট জেনারেট করতে অনেক বেশি হেল্প করে। বিষয়টা আরেকটু ডিটেইলে বোঝার ট্রাই করি চলুন৷ ফাইভারে গিগ ক্রিয়েট করার মাধ্যমে ক্লায়েন্টদের কাছে সার্ভিস সেল করা হয় এবং এখানে সেলারদের বিভিন্ন লেভেল থাকে। যেমনঃ লেভেল ওয়ান সেলার, লেভেল টু সেলার, টপ রেটেড সেলার ইত্যাদি। যদি কোন সেলারের লেভেল ওয়ান, টু বা টপ রেটেড থাকে, তাহলে ফাইভার সেই সেলারকে গিগ এক্সট্রাজ হিসেবে ক্নিজের সার্ভিস আপসেল করার সুযোগ দেয়।

এছাড়াও ফাইভারে ক্লায়েন্টদের কাছে নিজের সার্ভিসগুলোকে প্যাকেজ বা বান্ডেল হিসেবেও অফার করা যায়। এর ফলে সেলাররা তাদের যে বেসিক গিগগুলো রয়েছে সেগুলোকে বান্ডেল করে বিল্ট ইন রিভিশনসহ আরো এক্সট্রা কিছু যোগ করে ক্লায়েন্টদের অফার করতে পারেন। যেহেতু এতে বেসিক গিগের চেয়েও এক্সট্রা কিছু জিনিস অফার করা হয়, তাই বেশি পরিমাণে ইনকাম করা পসিবল হয় এবং প্রফিট জেনারেট হয়। ফাইভারে এই টেকনিকটা ফলো করে আমি খুব অল্প সময়েই বেশ হ্যান্ডসাম অ্যামাউন্টের রেভিনিউ জেনারেট করতে পেরেছিলাম।

এরপর যখন নিজের ডিজাইন এজেন্সি শুরু করলাম, এই টেকনিকটা সেখানেও কাজে লাগিয়েছিলাম তবে একটু ডিফারেন্ট উপায়ে। যেমনঃ আমি আমার ডিজাইন রিলেটেড কোন একটা সার্ভিসের জন্য ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে একবারে ফ্ল্যাট একটা অ্যামাউন্ট চার্জ না করে সেই সার্ভিসকে বিভিন্ন অ্যাড অনস এর মাধ্যমে আলাদা করে দিয়েছিলাম। তারপর ক্লায়েন্টদের ইনফ্লুয়েন্স করেছিলাম সেগুলো পারচেজ করার জন্য। এতে করে বিজনেস থেকে আমার প্রচুর প্রফিট হয়৷ এভাবে আমি বুদ্ধি খাটিয়ে ফাইভার থেকে শেখা টেকনিক নিজের বিজনেসে কাজে লাগিয়েছি এবং ভালো আউটপুটও পেয়েছি । 

এবার আমি ফাইভার থেকে শেখা আরেকটা বিষয় নিয়ে কথা বলবো৷ যেহেতু আমি একজন ডিজাইনার, তাই যখন ফাইভারে কাজ করতাম, তখন আমি ক্লায়েন্টদেরকে ডিজাইন রিলেটেড বিভিন্ন সার্ভিস অফার করতাম।এসময় যে লেসনটা আমি পেয়েছি সেটা হলো নিজের আগে করে রাখা একটা ডিজাইনকে ক্লায়েন্টের ডিমান্ড ফলো করে মোডিফাই করার মাধ্যমে যদি ডেলিভারি দেয়া যায় তাহলে সার্ভিস ডেলিভারি দেয়ার কাজে যেমন সময় বাঁচে তেমনিভাবে কিন্তু তুলনামূলক কম ইফোর্টেই কাজটা করে ফেলা যায়। এই প্রসেসটাকে প্রোডাক্ট রিপারপাজিংও বলা হয়। 

আপনি নিজেই ভেবে দেখুন, যদি প্রতিটা ক্লায়েন্টের ডিমান্ড ফলো করে নতুনভাবে ডিজাইন রেডি করতে যান, স্বাভাবিকভাবেই সময় এবং ইফোর্ট দুটোই বেশি দিতে হবে। আবার ক্লায়েন্টের কাছ থেকে বেশি বেশি অর্ডারও নিতে পারবেননা কারণ একজন ক্লায়েন্টের সার্ভিসের পেছনেই অনেকটা সময় খরচ করতে হবে। এর চেয়ে যদি ক্লায়েন্টের ডিমান্ড বুঝে যে অনুযায়ী নিজের এক্সিসটিং ডিজাইন মোডিফাই করে ক্লায়েন্টকে সেটা ডেলিভারি দেন তাহলে একেকটা সার্ভিসের পেছনে সময় অনেক কম লাগবে। এর ফলে বেশি বেশি অর্ডারও নিতে পারবেন। 

ফাইভারে কাজ করতে গিয়ে শেখা এই লেসনটা আমি নিজের বিজনেস শুরু করার পরেও অ্যাপ্লাই করে দেখেছি এবং পজিটিভ আউটকাম ও পেয়েছি। এই টেকনিকটা ফলো করে আমি একসাথে কয়েকজন ক্লায়েন্টের সাথে কাজ করার চান্স পেয়েছি এবং তাদেরকে সার্ভিস ডেলিভারি দিতেও লেইট হয়নি। যেহেতু আমি নিজে এই টেকনিকটা নিজের বিজনেসেও প্র‍্যাকটিকালি অ্যাপ্লাই করে ভালো একটা রেজাল্ট পেয়েছি, তাই বলতে পারি চাইলে এটা ফলো করে দেখতে পারেন। 

তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই যেটা মাথায় রাখবেন সেটা হলো, আগে ক্লায়েন্টের ডিমান্ড বুঝুন। তারপর ভাবুন তার ডিমান্ডের সাথে নিজের আগে থেকে করা কোন প্রজেক্টের সিমিলারিটি আছে কিনা এবং সেটাকে মোডিফাই করে ক্লায়েন্টকে ডেলিভারি দিলে সার্ভিসের কোয়ালিটি মেইনটেইনড হবে কিনা। কারণ সবসময় তো আর মোডিফাই করা প্রজেক্ট ডেলিভারি দেয়া পসিবল হয়না। একারণেই সাজেশন থাকবে শুরুতেই ক্লায়েন্টের ডিমান্ড ভালোমতো বুঝে নেয়া। 

আমি ফাইভারে কাজ করার সময় আরেকটা বিষয় লক্ষ করি। সেটা হলো ফাইভার কখনোই সেলারদেরকে তাদের পারসোনাল প্রোফাইল কিংবা বিজনেসের প্রোমোশন করতে দেয়না। যদি কেউ ক্লায়েন্টদের সাথে মেসেজিং করার সময় কোনোভাবে নিজের ফ্রিল্যান্সিং বিজনেসের লিংক শেয়ার করেও ফেলেন, ফাইভার তার অ্যাকাউন্ট রেস্ট্রিকটেড করে দেয়। আর একবার ফাইভার অ্যাকাউন্ট রেস্ট্রিকটেড হওয়া মানে একজন সেলারের বহুদিনের পরিশ্রম এক সেকেন্ডে মাটি হয়ে যাওয়া। এছাড়াও ফাইভারের অ্যালগরিদম রেগুলারলি আপডেট করা হয় যার কারণে অনেকের গিগ ফার্স্ট পেইজ থেকে চলে যায় এবং অর্ডার আসাও কমে যায়। সুতরাং নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, ফাইভারে যদি লং টার্ম কাজ করার প্ল্যান করেন তাহলে নিজের কোনো স্বাধীনতাই থাকবেনা। শুধু তাই নয়, টাকাপয়সা ইনকাম করার জন্য ফাইভারকেই একমাত্র টার্গেট করা বেশ রিস্কিও বটে। 

তাহলে কি ভাবছেন? ফাইভারে সার্ভিস অফার করবেন কিনা?

এক্ষেত্রে একজন এক্সপেরিয়েন্সড মানুষ হিসাবে আমি বলবো যাদের নিজেদের ফ্রিল্যান্সিং বিজনেস স্টার্ট করার প্ল্যান আছে তাদের শুরুতে ফাইভারে সার্ভিস অফার করা উচিৎ। কারণ কোনো একটা সেক্টরে নিজের স্কিল ডেভেলপ করার পর সেই সেক্টরে এক্সপার্টাইজ থাকা প্রয়োজন হয়। আর এই এক্সপার্টাইজ আসে বারবার প্র‍্যাকটিসের মাধ্যমে, অর্থাৎ যেই সেক্টরে স্কিল ডেভেলপ করেছেন সেই সেক্টর রিলেটেড অনেকগুলো প্রজেক্ট করার মাধ্যমে। ফাইভারে যেই সেক্টরেই সার্ভিস অফার করুননা কেন, ক্লায়েন্টদেরকে বিভিন্ন প্রজেক্ট ডেলিভারি দিতে হয়ই। এর ফলে নিজের স্কিল বাড়ে এবং একই সাথে এক্সপেরিয়েন্সও বাড়ে। যেই স্কিল এবং এক্সপেরিয়েন্স পরবর্তীতে যখন নিজের বিজনেস স্টার্ট করবেন, তখনও কাজে আসবে। মোটকথা, ফাইভারে আগে কাজ করলে নিজে যে সেক্টরে কাজ শিখেছেন, সে সেক্টরটা এক্সপ্লোর করার চান্স পাবেন, যা নিজের ফ্রিল্যান্সিং বিজনেসে বিভিন্নভাবে বেনিফিট এনে দেবে। 

আবার, যদি নিজের ফ্রিল্যান্সিং বিজনেস স্টার্ট করার আগে ফাইভারে কিছু সময় কাজ করেন তাহলে ক্লায়েন্টদের সাথে কমিউনিকেট করতে করতে নিজের কমিউনিকেশন স্কিলও বাড়বে। এর ফলে নিজের বিজনেসেও ইফেকটিভলি ক্লায়েন্টদের সাথে ইন্টারেক্ট করতে পারবেন। যা বিজনেসে প্রফিট জেনারেট করতে অনেক হেল্প করবে। 

সুতরাং, পরিশেষে আমি এটাই বলতে চাই, ফাইভার নিঃসন্দেহে এক্সপেরিয়েন্স গেইন করার জন্য ভালো একটা মার্কেটপ্লেস। তাই নিজের বিজনেস স্টার্ট করার আগে ৬ মাস কিংবা ১ বছর ফাইভারে কাজ করুন। তারপর সেখান থেকে যা যা শিখবেন সেগুলোকে পুঁজি করে ফ্রিল্যান্সিং বিজনেস স্টার্ট করুন। দেখবেন আনাড়ি হাতে বিজনেস শুরু না করে এক্সপেরিয়েন্সড হয়ে বিজনেস শুরু করার কারণে অন্যদের তুলনায় দ্রুতই সাকসেসফুল হবেন। 

 

পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন: