শাইনি অবজেক্ট সিনড্রোম থেকে পরিত্রাণ পেতে চাইলে

চট করে নিজের ছোটবেলার কথা মনে করুন তো একবার! যখন আপনাকে নতুন চকচকে একটা খেলনা দেয়া হতো, তখন কি আর পুরনো খেলনাগুলো নিয়ে খেলতে অতটা ভালো লাগতো? লাগতোনা তাইনা? বরং সমস্ত অ্যাটেনশন থাকতো ওই নতুন খেলনাটাকে ঘিরে। নিশ্চয়ই সবাই ভাবছেন যে এই বড়বেলায় এসে ছোটবেলার সেই পুরানো অভ্যাস নিয়ে এত কথা কেন বলছি। আসলে আমি এতক্ষণ সহজ করে সবার সামনে শাইনি অবজেক্ট সিনড্রোমের বেসিক কনসেপ্টটা তুলে ধরার ট্রাই করছিলাম৷ এটা মূলত একটাইপের ডিসট্র‍্যাকশন মানুষকে তাদের মেইন ফোকাস থেকে সরিয়ে দেয়। তবে যদি স্পেসিফাই করে বলি, যারা উদ্যোক্তা কিংবা ফ্রিল্যান্সিংয়ের সাথে ইনভলভড, তারা এক্ষেত্রে বেশি সাফার করে থাকেন। আজকের লেখায় আমি শাইনি অবজেক্ট সিনড্রোম কী এবং এটা থেকে কিভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে সেটা নিয়ে ডিসকাস করবো। 

শাইনি অবজেক্ট সিনড্রোম কী?

চলুন শুরুতেই শাইনি অবজেক্ট সিনড্রোমের ডেফিনিশন জেনে নেয়া যাক।এটা একধরণের সিনড্রোম বা মেন্টাল স্টেট যার ফলে মানুষ তার সামনে যে ট্রেন্ডিং বা “শাইনি “ টপিক পায় সেটার দিকেই নিজের সমস্ত কনসেনট্রেশান দিয়ে দেয়। এবং একইসাথে তার নিজের যেখানে একচুয়াল কনসেনট্রেশান দেয়া উচিৎ সেখান থেকে সরে যায়। যার ফলে পরবর্তীতে এক্সপেকটেড আউটপুট না পেয়ে নিজেকে সাফার করতে হয়৷ 

বলতে পারেন এতকিছু থাকতে এই প্রবলেমটাকে কেন শাইনি অবজেক্ট সিনড্রোম বলা হয়? আমি ই বলে দিচ্ছি। জেনারেলি ছোট বাচ্চারা নতুন চকচকে কোন কিছু পেলে তাদের পুরানো খেলনা নিয়ে না খেলে ওই চকচকে বা শাইনি জিনিসটা নিয়েই খেলতে থাকে। ঠিক একইভাবে শাইনি অবজেক্ট সিনড্রোমে ভুগেন তারা যখনই নতুন কোন আইডিয়া পান অথবা কোন নতুন ট্রেন্ডিং টপিক দেখেন, সাথে সাথেই তারা সেটা নিয়েই বিজি হয়ে যান। এমনকি তারা বেমালুম ভুলে যান তাদের ইচ্ছা কী বা তাদের একচুয়াল প্যাশন কোথায়। 

একটা রিয়েল লাইফ এক্সামপল দিচ্ছি। ফ্রিল্যান্সিং এখনকার যুগের জনপ্রিয় ক্যারিয়ার চয়েসগুলোর একটা যেখানে গ্রাফিক ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং,ওয়েব ডেভেলপমেন্ট ইত্যাদি বিভিন্ন সেক্টরে নিজের স্কিল ডেভেলপ করে ক্লায়েন্টদের সার্ভিস প্রোভাইড করা যায়। খেয়াল করলে দেখবেন, যারা ফ্রিল্যান্সিংয়ে বিগিনার এবং এই সেক্টরে ক্যারিয়ার বিল্ডআপ করতে ইন্টারেস্টেড, তারা একেকসময় একেকটা সেক্টরের দিকে ইন্টারেস্টেড ফিল করে।

যেমন ধরুন, কেউ হয়তো ইউটিউবে একজন সাকসেসফুল ওয়েব ডেভেলপারের ইন্টারভিউ দেখলো। ভিডিওটা দেখার পর তার মনে হলো ওয়েব ডেভেলপমেন্টই তার জন্য পারফেক্ট চয়েস। আবার তার কিছুদিন পর ফেসবুকে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের ডিমান্ড কতটা বেশি এটা নিয়ে একটা আর্টিকেল পড়ার পর সে ডিসাইড করলো যে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট বাদ, তাকে ডিজিটাল মার্কেটিং সেক্টরেই কাজ করতে হবে। শাইনি অবজেক্ট সিনড্রোমের ব্যাপারটা এমনই। যারা এটায় ভোগেন, তারা কোনভাবেই ফোকাস ঠিক রাখতে পারেননা। যার ফলে নিজেরা যথেষ্ট স্কিলড হওয়া সত্ত্বেও আর্নিং বাড়াতে স্ট্রাগল করেন। 

 

এই সিনড্রোম কী কী প্রবলেম ক্রিয়েট করে?

এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে আপনি -আমি -আমরা কমবেশি সবাই ই লাইফে কখনো না কখনো শাইনি অবজেক্ট সিনড্রোম ফেইস করেছি। শাইনি অবজেক্ট সিনড্রোমের ফলে  মেইনলি যে প্রবলেমগুলো ক্রিয়েট হয় সেগুলো হলো –

১। মানুষের প্রোডাকটিভিটি কমে যায়। কারণ যখন একজনের মধ্যে কনস্ট্যান্টলি একটা আইডিয়া বা মাইন্ডসেট থেকে অন্য আইডিয়ায় শিফট করার টেনডেন্সি থাকে, তখন যত ট্রাই ই করা হোক না কেন, কিছুতেই কাজে ফোকাস করা বা কনসেনট্রেট করা পসিবল হয়না। কেননা তখন মনে একধরণের অস্থিরতা চলতে থাকে। ফলস্বরূপ নিজের কাজের প্রতি মোটিভেশান কমে যায় যেটা প্রোডাকটিভিটিও কমিয়ে দেয়। এছাড়াও যারা এই প্রবলেমে ভুগেন, তারা অপ্রয়োজনে কাজের পেছনে প্রচুর টাকা-পয়সা খরচ করেন। যেগুলো প্রয়োজন নেই সেগুলো অন্যদের কিনতে দেখে নিজে কেনার ট্রাই করেন। এতে যেমন টাকার অপচয় হয় তেমনিভাবে কিন্তু নিজের ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্টেরও হ্যাম্পার হয়। 

২। যারা শাইনি অবজেক্ট সিনড্রোমে ভুগেন, তারা কখনোই একটা আইডিয়ায় স্টিক করে থাকতে পারেননা। একারণে দেখা যায় তারা কোনো আইডিয়াই ঠিকমতো এক্সিকিউট করতে পারেননা। যার ফলে দেখা যায় তারা যেই প্রোজেক্টেই নিজেদের সময় এবং ইফোর্ট দেননা কেন, শেষ পর্যন্ত সেই প্রোজেক্টগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই আনফিনিশড থেকে যায়। 

৩। যারা উদ্যোক্তা কিংবা টিম নিয়ে ফ্রিল্যান্সিং করে থাকেন তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় শাইনি অবজেক্ট সিনড্রোমের কারণে তারা টিমমেটদের সাথে সঠিকভাবে কমিউনিকেট করতে পারেননা। কারণ তারা কখনোই একটা পারটিকুলার প্রোজেক্টে স্টেবল থাকতে পারেননা। এছাড়াও একেকবার একেকরকম প্রোজেক্টে কাজ করার ট্রাই করার কারণে টিমমেটরাও তাদের ওপর থেকে ট্রাস্ট হারিয়ে ফেলেন৷ 

কিভাবে শাইনি অবজেক্ট সিনড্রোম থেকে পরিত্রাণ পেতে পারেন?

শাইনি অবজেক্ট সিনড্রোম নিঃসন্দেহে একটা বড় ধরণের প্রবলেম। তবে আশার কথা হলো সব প্রবলেমেরই সলিউশন থাকে। তাই চলুন আর দেরি না করে জেনে আসা যাক ঠিক কিভাবে শাইনি অবজেক্ট সিনড্রোম থেকে পরিত্রাণ পাওয়া পসিবল হবে। 

১। সবার আগে যেটা করতে হবে সেটা হলো যখন নিজের গোল সেট করবেন, ট্রাই করবেন অ্যাচিভেবল গোল সেট করতে। মনে রাখবেন, প্রত্যেকটা মানুষের স্কিল, মাইন্ডসেট এবং কাজ করার অ্যাবিলিটি আলাদা। তাই অন্যদের দেখে কিংবা হুজুগে পড়ে নিজের জন্য এমন কোন গোল সেট করবেননা যেটা অ্যাচিভ করার ক্যাপাবিলিটি আপনার নেই৷ নিজের ফ্রিল্যান্সিং বিজনেস বলুন বা নরমাল কোন বিজনেস, যখন অ্যাচিভেবল গোল সেট করবেন তখন দেখবেন সামনে যত বড় ডিসট্র‍্যাকশন ই আসুক না কেন, নিজের কাজের ক্ষেত্র থেকে ফোকাস সরবেনা। 

২। শাইনি অবজেক্ট সিনড্রোম থেকে বের হয়ে আসার জন্য ট্রাস্টেবল কারো হেল্প নিন যিনি সঠিক ডিসিশন নিতে হেল্প করতে পারবেন। তিনি হতে পারেন ফ্যামিলির কেউ বা কাছের কোন ফ্রেন্ড। যখনই নিজের মাথায় থাকা আইডিয়া বাদ দিয়ে অন্য কোন ট্রেন্ডিং আইডিয়াতে ফোকাস করতে ইচ্ছা হবে, সেই ট্রাস্টেবল মানুষটার সাথে কথা বলুন৷ তাকে জিজ্ঞেস করুক যে নতুন আইডিয়াতে যে কাজ করতে চাচ্ছেন সেটা কতটুকু উচিৎ হবে৷ দেখবেন এভাবে কথা বললে নিজেই ডিসিশন নিতে পারবেন যে কোন আইডিয়াতে একচুয়ালি ফোকাস করতে হবে এবং কোন আইডিয়াগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে হবে। 

৩। যারা শাইনি অবজেক্ট সিনড্রোমের সাফারার, তারা বেশিরভাগ টাইমেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকাপয়সা খরচ করে বসেন। জানেন এটা কমানোর জন্য কি প্রয়োজন? এটা কমাতে প্রয়োজন নিজের স্ট্রং মাইন্ডসেট থাকা। নিজেকে এটা বোঝান যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যয় করলে সেটাতে নিজের বিজনেসের লস ই হবে। নিজের সাথে বোঝাপড়া করুন এবং ডিটারমাইনড থাকুন যে আপনার সামনে যতই আপডেটেড কোন গ্যাজেট, টুল বা সফটওয়্যার আসুক না কেন সেগুলোর পেছনে টাকা নষ্ট করা চলবেনা। বরং এমন গ্যাজেট বা টুলের জন্য টাকা ইনভেস্ট করতে হবে যেগুলো অ্যাকচুয়ালিই প্রয়োজনীয়। 

৪। নিজের চারপাশে যখনই কোন ট্রেন্ডিং টপিক বা আইডিয়া দেখবেন যেগুলো নিয়ে সবাই অনেক হাইপ তুলছে, সেসব থেকে নিজের মনোযোগ সরিয়ে রাখুন। আমি জানি এটা বেশ কষ্টের একটা কাজ। তাই আস্তে আস্তে ট্রাই করুন যেন যতই ডিসট্র‍্যাকশন আসুক, নিজে যে কাজটা করছেন সেই কাজটা যেন কনসেনট্রেশান দিয়ে ভালোমতো করতে পারেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো উপায় হলো নিজেকে প্রশ্ন করুন যে এই হাইপ নিজের বিজনেস বা ফ্রিল্যান্সিংয়ে কতটুকু বেনিফিট এনে দিতে পারবে। দেখবেন যখনই নিজেকে এভাবে প্রশ্ন করবেন এবং প্রশ্নের উত্তর ফাইন্ড আউট করতে পারবেন, তখন শাইনি অবজেক্ট সিনড্রোম থেকে বের হয়ে আসা অনেকটা ইজি হয়ে যাবে। 

সুতরাং, এটুকুই ছিলো আজকের ডিসকাশন। আমার এই পারটিকুলার টপিকটা নিয়ে আলোচনা করার মূল কারণ হচ্ছে আমি রিয়েল লাইফে অনেককে দেখেছি যারা শাইনি অবজেক্ট সিনড্রোমের কারণে এনাফ পটেনশিয়াল থাকার পরেও নিজের বিজনেস থেকে তাদের এক্সপেকটেড আউটপুট পায়নি। আমার মতে এখনো অনেকে স্পেশালি ইয়াং জেনারেশন এই প্রবলেমটা নিয়ে অনেক বেশি সাফার করে। তাদেরকে আমি বলবো, নিজের শাইনি অবজেক্ট সিনড্রোমজনিত প্রবলেম রয়েছে কিনা সেটা আগে আইডেন্টিফাই করুন এবং এরপর আমার আজকে উল্লেখ করা সাজেশনগুলো ফলো করুন। আশা করি খুব তাড়াতাড়ি ভালো একটা রেজাল্ট পাবেন। 

 

পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন: