আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কি ফ্রিল্যান্সারদের রিপ্লেস করতে সক্ষম?

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বর্তমান সময়ের সবচাইতে আলোচিত টপিকগুলোর মধ্যে একটা। এটা নিয়ে মানুষের কৌতুহল সবসময়ই ছিলো, তবে ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে যখন চ্যাট জিপিটি নামক চ্যাটবট রিলিজ হওয়ার পর থেকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে সবাই নতুন করে ভাবতে শুরু করে।

এ ভাবনা থেকে বাদ যায়নি ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরও। অদূর ভবিষ্যতে এই অত্যাধুনিক এ.আই টুলগুলো ফ্রিল্যান্সারদের রিপ্লেস করে ফেলতে পারবে কিনা -এ নিয়ে কনফিউশানে পড়ে গেছেন অনেকেই। আজকের লেখায় আপনাদের জানাবো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সত্যিকার অর্থেই ফ্রিল্যান্সারদের রিপ্লেস করতে পারবে কিনা সে সম্পর্কে বিস্তারিত।

চলুন লেখার শুরুতেই আপনাদেরকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে একটু ধারনা দেয়া যাক। একদম সহজ করে বলতে গেলে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হচ্ছে কম্পিউটার সাইন্স ও উন্নত টেকনোলজি কাজে লাগিয়ে সৃষ্টি করা এমন বুদ্ধিমত্তা, যেটা মানুষের বুদ্ধিমত্তার অনুরূপ।

বর্তমানে এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন মেশিন, টুল ও চ্যাটবট তৈরি করা হচ্ছে, যেগুলোর মধ্যে চ্যাট জিপিটি, জিপিটি থ্রি, জিপিটি ফোর কিংবা মিড জার্নি এ.আই অন্যতম। এখন আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন, সাধারণ টুলের সাথে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিজাইন করা টুলের ডিফারেন্স কোথায়। এবার সেটার উত্তর দিচ্ছি।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করা হয়েছে এমন টুলগুলো কোনো কমান্ড ফলো করা বা রেসপন্স করার ক্ষেত্রে মানুষের মতো লজিক্যালি অ্যানালাইসিস করতে পারে। একারণে এগুলো যে আউটপুট শো করে, সেগুলো দেখলে আপনার কাছে মনে হবে এই আউটপুট বুঝি কোনো মানুষই দিয়েছে।

যেমন: চ্যাট জিপিটির কথাই ধরুন না! যে কোন কোশ্চেনের অ্যান্সার পেতে, টেক্সটের সামারি কিংবা ট্রান্সলেশন করতে ন্যাচারাল ল্যাংগুয়েজ প্রসেসিং মডেল চ্যাট জিপিটির জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। কারণ এই চ্যাটবটটা ইউজারদের যে আউটপুট প্রোভাইড করে, সেটা দেখলে মনে হয় কোনো মানুষের রেসপন্স।

মূলত এই একটা কারণেই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ফ্রিল্যান্সারদের কাজের সুযোগ কমিয়ে ফেলতে পারে কিনা সেটা নিয়ে একটা বড়সড় ডিবেট তৈরি হয়েছে।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কি সত্যিকার অর্থেই ফ্রিল্যান্সারদের রিপ্লেসমেন্ট হতে পারে? 

যদি আমি এক কথায় এই প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই, তাহলে বলতে হয়, না! আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কখনোই ফ্রিল্যান্সারদের রিপ্লেস করতে বা তাদের কাজের সুযোগ কমাতে ক্যাপাবল নয়। কেন জানেন? যতই উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে একেকটা এ.আই টুল তৈরি করা হোক না কেন, এগুলোর কিছু লিমিটেশনস সবসময় থাকে।

প্রথমত, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স যতই শক্তিশালী হোক, এটা কখনোই মানুষের মতো ক্রিটিক্যাল ও ইন ডেপথ থিংকিংয়ের মাধ্যমে ইউনিক আইডিয়া বা কনসেপ্ট বের করতে পারবেনা। যেমন ধরুন: আপনি এ.আই টুল দিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই টেক্সট, ইমেজ এমনকি ভিডিও জেনারেট করে ফেলতে পারলেও মানুষের মতো ইউনিক এবং একইসাথে ক্রিয়েটিভ কোনো কন্টেন্ট জেনারেট করতে পারবেননা।

তাই যারা গ্রাফিক ডিজাইন,ওয়েব ডিজাইন, ভিডিও এডিটিংয়ের মতো ক্রিয়েটিভ সেক্টরে কাজ করেন,  তারা এটুকু নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যতই আপগ্রেডেড ভার্সন আসুক না কেন, সেটা আপনাদের ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ারে কোনোভাবেই বাজে ইমপ্যাক্ট ফেলতে পারবে না। কারণ এসব সেক্টরে টিকে থাকতে গেলে প্রতিনিয়ত যে আউট অফ দ্যা বক্স আইডিয়াগুলো জেনারেট করতে হয়, সেটা একমাত্র হিউম্যান ব্রেইন থেকেই জেনারেট হওয়া পসিবল।

দ্বিতীয়ত, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করলে কনটেন্ট ডুপ্লিকেশনের অনেক বড় চান্স থাকে। সেইসাথে এ.আই টুলগুলো যে ডেটা শো করে, সেই ডেটার ভ্যালিডিটি নিয়েও কিন্তু সন্দেহ থেকেই যায়। তাই যারা কনটেন্ট রাইটিং বা রিসার্চ সেক্টরে  ফ্রিল্যান্সিং করছেন, তাদের ক্যারিয়ারও কিন্তু পুরোপুরি সিকিউরড। কারণ কোন ক্লায়েন্টই চাইবেন না যে তাদের কন্টেন্টে প্লেজিয়ারিজম থাকুক কিংবা কনটেন্টে প্রোভাইড করা তথ্যের ভ্যালিডিটি নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলুক।

তৃতীয়ত, এ.আই টুলগুলোর কোনো অরিজিনালিটি বা নিজস্বতা নেই। বরং এগুলো ডিজাইন করা হয়েছে ইনটেলিজেন্ট অ্যালগোরিদমের মাধ্যমে অনেকরকম ডেটার সমন্বয়ে। যখন এই টুলগুলো একেকটা রেসপন্স জেনারেট করে, সে রেসপন্সগুলো হয় টুলের মধ্যে থাকা ডেটাগুলো অ্যানালাইসিস করার মাধ্যমে। তাই এই টুলগুলো ইউজ করলে নতুন কোনো আইডিয়া বা কনসেপ্ট ক্রিয়েশন কখনোই পসিবল নয়। আপনারা এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন ডেটা অ্যানালাইসিস করে রেসপন্স করা আর মানুষের মতো গভীরভাবে চিন্তা করে ফ্রেশ ও ইউনিক আইডিয়া বের করা- এ দুটোর মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত। তাই এদিক থেকেও কিন্তু আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স ফ্রিল্যান্সারদের টপকাতে ব্যর্থ।

সুতরাং এটুকু নির্দ্বিধায় বলা যায়, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অনেক দিক থেকে হাইলি ক্যাপাবল হলেও এটা মানুষের মতো ক্রিয়েটিভিটি যেমন শো করতে পারবেনা, তেমনি মানুষের মতো প্রতিটা কেইসে লজিক্যাল জাজমেন্ট দেয়ার ক্ষমতাও এটার নেই। একারণে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ফ্রিল্যান্সারদের রিপ্লেসমেন্ট হতে পারবে না।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কি ফ্রিল্যান্সারদের রিপ্লেস করতে সক্ষম?

তবে হ্যাঁ, যেহেতু বর্তমানে এমন অনেক এ.আই টুল অ্যাভেইলেবল রয়েছে সেগুলো ফ্রিল্যান্সারদের কাজকে অনেক সহজ করে তুলতে পারে, তাই ফ্রিল্যান্সাররা চাইলে বিভিন্ন এ.আই টুল ব্যবহার করে তারা তাদের প্রোডাক্টিভিটি অনেক গুন বাড়িয়ে তুলতে পারেন।

সেই সাথে যদি তারা সঠিকভাবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সাহায্য নিতে পারেন, তাহলে তারা যেমন আরো ইফেক্টিভলি টাইম ম্যানেজমেন্ট করতে পারবেন, সেই সাথে তাদের ওয়ার্ক লাইফ ব্যালেন্সও ঠিক থাকবে। কিভাবে? চলুন জেনে নেয়া যাক।

  • ফ্রিল্যান্সাররা তাদের ইমেইল ম্যানেজমেন্ট করার সময়সাপেক্ষ কাজকে সহজ করে তোলার জন্য ব্যবহার করতে পারেন সুপার হিউম্যান নামক টুল। এতে করে গুরুত্বপূর্ণ ইমেইল প্রায়োরাটাইজ করা, টাস্ক অ্যাসাইন করা, ডেইলি স্কেজিউল ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে। সেই সাথে অনেক সময়ও বেঁচে যাবে।
  • ক্লায়েন্টদের সাথে মিটিংয়ের কাজগুলো সহজ করে তুলতে ইউজ করতে পারেন স্ল্যাক নামক এ.আই টেকনোলজি ভিত্তিক  কমিউনিকেশন টুল। এই টুলে রয়েছে বিভিন্ন অ্যাট্রাকটিভ ফিচারস, যেমন: ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং, মিটিং প্ল্যানার ইত্যাদি যেগুলো একজন ফ্রিল্যান্সারকে কোন ক্লায়েন্টের সাথে কবে ও কখন মিটিং রয়েছে সে বিষয়ে আপডেটেড রাখার পাশাপাশি ক্লায়েন্টদের সাথে প্রোপারলি কমিউনিকেট করতেও হেল্প করবে।
  • ফ্রিল্যান্সিং বিজনেসের মার্কেটিংয়ের জন্য অল্প সময়ে ক্লায়েন্টদের ইমেজ জেনারেট করতে ইউজ করতে পারেন মিড জার্নি এ.আই। এই টুলটার বিশেষত্ব হলো কিছু ডেসক্রিপশন ইনপুট করলেই খুব দ্রুত এটা  ক্লায়েন্টদের ইমেজ জেনারেট করে দেয়।

  • যদি কোনো টপিকে দ্রুত রিসার্চ করার প্রয়োজন হয়, তাহলে হেল্প নিতে পারেন ভাইরাল চ্যাটবট চ্যাট জিপিটির। এই টুলটার জেনারেট করা রেসপন্সগুলো পড়তে খুব ইজি হওয়ায় রিসার্চের জন্য এটা হতে পারে আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড।
  • ভালো কাস্টমার সার্ভিস প্রোভাইড করা প্রতিটা ফ্রিল্যান্সারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রেসপনসিবিলিটি। এক্ষেত্রে টপ নচ কাস্টমার সার্ভিস প্রোভাইড করতে হেল্প নিতে পারেন মাইক্রোসফটের আজুরে বট সার্ভিসের মতো কনভারসেশনাল এ.আই বটের। এতে করে ক্লায়েন্টদের যেকোনো প্রশ্নে দ্রুত রেসপন্স করতে পারবেন এবং এটা দিনশেষে কাস্টমারদের স্যাটিসফ্যাকশনও অনেকগুণ  বাড়িয়ে তুলবে।

  • ফ্রিল্যান্সিংয়ের মার্কেটিং কিংবা সার্ভিস ডেসক্রিপশনের জন্য একটু লেখালেখি তো করতেই হয়। আপনার লেখার ভুলগুলো চেক করার জন্য এবং সেই সাথে লেখার কোয়ালিটি বাড়িয়ে তুলতে ইউজ করতে পারেন গ্রামারলি। একইসাথে যদি কোনো কন্টেন্টের আউটলাইন তৈরি করতে চান, তাহলে ইউজ করতে পারেন কপি.এ আই।

  • ক্লায়েন্টদের সার্ভিস দেয়ার পর পেমেন্ট রিসিভ করতে ইনভয়েস সবসময় দরকার হয়। বারবার ইনভয়েস ডিজাইন করে সময় নষ্ট করার চাইতে ফ্রিল্যান্সাররা ইউজ করতে পারেন ইনভয়েস নিনজা নামের এ আই টুল। সিম্পল ইউজার ইন্টারফেস থাকা এ টুল ব্যবহার করলে ফ্রিল্যান্সারদের ইনভয়েস জেনারেট করার কাজটা অনেক সহজ হয়ে যাবে।

পরিশেষে বলা যায়, ফ্রিল্যান্সাররা যদি নিজেদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এমন টুলগুলো ইউজ করেন, তাহলে তাদের প্রোডাক্টিভিটি ও কাজের স্পিড দুটোই নি:সন্দেহে বাড়বে। এতে করে তারা ক্লায়েন্টদেরকে আরো হাই কোয়ালিটির সার্ভিস প্রোভাইড করতে পারবেন। যার ফলে ক্লায়েন্টদের স্যাটিসফেকশন বাড়বে, এই স্যাটিসফ্যাকশনটাই সব ফ্রিল্যান্সারের ক্যারিয়ার সাকসেসফুল করতে অনেক হেল্প করে। তাই সবার প্রতি পরামর্শ থাকবে, এ.আই টুলগুলোকে ক্যারিয়ারের শত্রু না ভেবে বন্ধু ভাবতে শিখুন,দেখবেন লাইফ অনেকটা ইজি হয়ে গেছে।

পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন: