ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ার একদম যখন শুরুর দিকে, তখন ক্লায়েন্ট খুঁজে পাওয়ার মাধ্যমে কাজ শুরু করার জন্য মোটামুটি সবারই প্রথম চয়েস থাকে অনলাইন বেইজড ফ্রিল্যান্সিং সাইটগুলো। যারা এ প্রফেশনের সাথে যুক্ত আছেন, তারা সবাই নিশ্চয়ই ফাইভার, আপওয়ার্ক কিংবা পিপল পার আওয়ারের মতো ফ্রিল্যান্সিং সাইটগুলো সম্পর্কে জানেন এবং সেগুলোতে কাজও করেছেন। তবে আমাদের দেশের ফ্রিল্যান্সারদের মধ্যে আমি একটা টেনডেন্সি লক্ষ্য করেছি। সেটা হচ্ছে তারা এই ফ্রিল্যান্সিং সাইটগুলোতে কাজ করতে করতে একসময় সেগুলোর ওপর পুরোপুরি ডিপেন্ডেন্ট বা নির্ভর হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে দেখা যায়, এ নির্ভরতার কারণে তাদেরকে বিভিন্নভাবে সাফার করতে হয়৷ সত্যি বলতে একদম বিগিনারদের জন্য এ ধরণের সাইটগুলোতে কাজ করা পারফেক্ট হলেও লং-টার্মের জন্য এসব সাইটে কাজ করার মাইন্ডসেট রাখা কখনোই উচিৎ নয়। বরং প্রত্যেকের উচিৎ কিভাবে নিজের ফ্রিল্যান্সিং বিজনেস ডেভেলপ করা যায় সেদিকে ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই একটু একটু করে ফোকাস করা। আজকের লেখায় আমি ডিসকাস করবো ফ্রিল্যান্সিং সাইট থেকে নির্ভরতা সরিয়ে নিজের বিজনেস ডেভেলপ করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে। বলে রাখা ভালো, আজকের লেখাটা আমি পুরোপুরি আমার নিজের এক্সপেরিয়েন্স থেকে লিখছি। তাই আশা করছি এই আর্টিকেলের এ টু জেড সবাই মনোযোগ দিয়ে পড়বেন৷
ফ্রিল্যান্সিং সাইট কেন লং-টার্মে কাজ করার জন্য উপযোগী নয়?
চলুন একটা রিয়েল লাইফ এক্সামপলের মাধ্যমে শুরু করি। ধরা যাক, রহিম গ্রাফিক ডিজাইনে অত্যন্ত পারদর্শী। তিনি তার এ স্কিল কাজে লাগিয়ে সেল্ফ ডিপেন্ডেন্ট হওয়ার উদ্দেশ্যে একটা জনপ্রিয় ফ্রিল্যান্সিং সাইটে কাজ করা শুরু করলেন এবং কিছুদিনের মধ্যে ক্লায়েন্ট পেতে লাগলেন। ধীরে ধীরে তার ক্লায়েন্টের সংখ্যা বাড়তে লাগলো, একইসাথে বাড়তে লাগলো পজিটিভ রিভিউয়ের সংখ্যা এবং আয়ের অংক দুটোই। রহিম ভাবলেন যেহেতু ক্লায়েন্টদের থেকে ভালো রেসপন্স আসছে, এজন্যে তিনি এই ফ্রিল্যান্সিং সাইটেই সবসময় কাজ করবেন। সবকিছু ভালোই যাচ্ছিলো। কিন্তু একদিন হঠাৎ করে তিনি দেখলেন ফ্রিল্যান্সিং সাইটে তার যে প্রোফাইল ছিলো সেটা পারমানেন্টলি ডিজেবল করে দেয়া হয়েছে। রহিম এরপর অনেক চেষ্টার পরেও সে প্রোফাইলটা রিকভার করতে পারলেননা। তিনি পরবর্তীতে আফসোস করতে লাগলেন যে তিনি কেন শুধুমাত্র এই ফ্রিল্যান্সিং সাইটের ওপর নির্ভর করে ছিলেন এবং কেন তিনি কোনোরকম ব্যাকআপ প্ল্যান রাখেননি৷এমন ঘটনা রহিমের একার সাথেই ঘটেনি, বরং অনেক ফ্রিল্যান্সার রয়েছেন যাদের সাথে এরকম ঘটনা ঘটেছে।
অনলাইন বেইজড ফ্রিল্যান্সিং সাইটগুলোর মেইন প্রবলেম কিন্তু এটাই। এসব সাইটে কোন স্ট্যাবিলিটি নেই৷ এসব সাইটের অথোরিটি যখন চাইবে তখনই তারা আপনার প্রোফাইল ডিজেবল করে দিতে পারে। তারা আপনার আর্নিং কিংবা কতগুলো পজিটিভ রিভিউ রয়েছে সেগুলো নিয়ে মোটেও কনসার্নড নয়। ফলস্বরূপ যদি একবার তারা কারো অ্যাকাউন্ট পার্মানেন্টলি ডিঅ্যাকটিভেট করে দেয়, তখন হাজার চেষ্টার পরেও সেটা রিকভার করা যায়না। অর্থাৎ, এসব সাইটে কাজ করলে সবসময়ই যে কাজ করে যেতে পারবেন এমন কোন গ্যারান্টিই নেই৷
এছাড়াও এ ধরণের সাইটগুলো সবসময়ই যারা সাইট থেকে সার্ভিস নিয়ে থাকেন অর্থাৎ যারা ক্লায়েন্ট তাদের প্রতি বেশি ফোকাসড থাকে৷ ফ্রিল্যান্সারদের চেয়ে ক্লায়েন্টদের প্রতিই তাদের মনোযোগ বেশি থাকে৷ একারণে ক্লায়েন্ট বাজে রিভিউ দিলেও তারা অনেক সময় ফ্রিল্যান্সারদের ওই সাইটে কাজ করার সুযোগ বন্ধ করে দেয়। মোটকথা, একজন ফ্রিল্যান্সারের ইনকাম বা পজিটিভ রিভিউ যত বেশি ই থাকুকনা কেন, এসব সাইটে তার ইনকামের কোন স্ট্যাবিলিটি নেই।
ফ্রিল্যান্সিং সাইটগুলোতে কাজের ক্ষেত্রে আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করা যায়। সেটা হলো এসব সাইটে কাজের ক্ষেত্রে ফ্রিল্যান্সারদের সবসময় সেই সাইটের নিয়ম মেনেই কাজ করতে হয়, কেননা নিয়ম না মানলেই আইডি ডিঅ্যাকটিভেট হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। আপনি ক্লায়েন্টদেরকে যে ধরণের সার্ভিসই দিতে যাননা কেন, সেটা সাইটের নিয়ম ফলো করে দিতে হয়৷ এতে করে নিজের স্বকীয়তা প্রকাশের কোন সুযোগ পাওয়া যায়না।
পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং সাইটগুলোতে ক্লায়েন্টদেরকে সার্ভিস দেয়ার মাধ্যমে যে পরিমাণ অর্থ আয় হয়, সেখান থেকে একটা অংশ লভ্যাংশ হিসেবে অনেক সাইটকে দিতে হয়। অর্থাৎ যে টাকা ইনকাম করবেন সেটার পুরোপুরি অংশ নিজে পাবেননা।
আমি যদি জনপ্রিয় ফ্রিল্যান্সিং সাইট ফাইভার নিয়ে বলতে যাই, তাহলে দেখা যায় এই সাইটে মেইনলি গিগ পাবলিশের মাধ্যমে ক্লায়েন্টদেরকে সার্ভিস অফার করা হয়৷ যতদিন গিগ র্যাংকে থাকে, ততদিনই মূলত একজন ফ্রিল্যান্সার এখান থেকে ক্লায়েন্ট পেয়ে থাকেন৷ অনেকসময় দেখা যায়, গিগের র্যাংকিং চলে যায়৷ তখন ফ্রিল্যান্সার যত এক্সপার্ট হোননা কেন কিংবা যত চেষ্টাই করুননা কেন, তিনি কিন্তু আর আগের মতো ক্লায়েন্ট পাননা। ফলে দেখা যায়, তারা ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে পড়েন এবং ব্যাকআপ প্ল্যান না থাকায় বুঝতে পারেননা কিভাবে কি করবেন৷
সুতরাং, বলা যেতে পারে একজন ফ্রিল্যান্সারের কখনোই শুধুমাত্র অনলাইনের বিভিন্ন ফ্রিল্যান্সিং সাইট গুলোর ওপর নির্ভর করা উচিৎ নয়। কারণ যতই এক্সপার্টাইজ বা ইনকাম থাকুকনা কেন, দিনশেষে এসব সাইটে কিন্তু কোন স্ট্যাবিলিটি ই নেই।
তাহলে কী করবেন?
এতক্ষণে নিশ্চয়ই সবাই বুঝে গিয়েছেন যে কোন ফ্রিল্যান্সারেরই “শুধুমাত্র অনলাইন বেইজড সাইটগুলোতেই কাজ করবো ” – এমন মেন্টালিটি থাকলেও সেটা ঝেড়ে ফেলে দেয়া উচিৎ। একইসাথে সবার নিজের ফ্রিল্যান্সিং বিজনেস ডেভেলপ করার দিকেও নজর দেয়া উচিৎ। যেমনঃ কেউ যদি অনলাইন মার্কেটপ্লেসে গ্রাফিক ডিজাইনের কাজ করে থাকেন, তাহলে তিনি চাইলেই নিজের গ্রাফিক ডিজাইন বিজনেস গড়ে তুলতে পারেন। চলুন একনজরে নিজের বিজনেস থাকার বেনিফিটগুলো জেনে নেয়া যাক।
নিজের ফ্রিল্যান্সিং বিজনেস থাকার অন্যতম বড় সুবিধা হলো স্ট্যাবিলিটি থাকা। নিজের বিজনেসে অনলাইন সাইটগুলোর মতো যেকোন সময় অ্যাকাউন্ট পার্মানেন্টলি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কোন চান্স থাকেনা। শুধু তাই নয়, এখানে আপনাকে অন্য প্রতিষ্ঠানের অধীনে তাদের তৈরি করা রুলস মেনে কাজ করতে হবেনা। বরং নিজের ফ্রিল্যান্সিং বিজনেসে আপনিই আপনার বস। তাই বিজনেস পলিসি কেমন হবে, ঠিক কিভাবে বিজনেস গ্রো করবেন অথবা কিভাবে পটেনশিয়াল ক্লায়েন্টদের কাছে রিচ করবেন সেটা নিজে ডিসাইড করার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। তাই এখানে নিশ্চিন্তে নিজের স্বকীয়তাও দেখাতে পারবেন। অর্থাৎ নিজের বিজনেস থাকলে সেটাতে কাজ করে শান্তি পাওয়া যায় যা ফ্রিল্যান্সিং সাইটগুলো কখনোই দিতে পারেনা।
এছাড়াও আরেকটা বড় সুবিধা হচ্ছে নিজের ফ্রিল্যান্সিং বিজনেস থেকে যেটুকু আর্ন করবেন সেটা পুরোটাই নিজের থাকে। এখানে কোন সাইটকে নিজের আর্নিংয়ের একটা অংশ দিতে হবেনা। পাশাপাশি নিজের ফ্রিল্যান্সিং বিজনেসে অনলাইন সাইটের মতো গিগের র্যাংক হারিয়ে ক্লায়েন্ট না পাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেনা। কারণ এ বিজনেসগুলোতে ক্লায়েন্ট খুঁজে পাওয়ার পুরো প্রসেস পরিচালনা করা হয় প্ল্যানিং, নিজের এক্সপার্টাইজ এবং মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজির ওপর ভিত্তি করে। একারণে যদি প্রোপার প্ল্যানিং এবং মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজির মাধ্যমে ঠিকমতো একবার বিজনেস দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারেন, তাহলে আর ক্লায়েন্ট পাওয়া নিয়েও ভাবতে হবেনা। বরং দেখবেন, পছন্দ মতো ক্লায়েন্টের সাথে কাজ করার সুযোগ তো পাবেনই, উপরন্তু ঠিকমতো সার্ভিস দিতে পারলে একজন ক্লায়েন্টই আপনার কাছ থেকে বারবার সার্ভিস নিতে আসবেন। অর্থাৎ, নিজের বিজনেস থাকলে আইডিয়াল ক্লায়েন্টও পাবেন যেটা অনলাইন সাইটে কাজ করে পাওয়া খুব একটা পসিবল হয়না।
তাহলে সবকিছু মিলিয়ে নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, শুধুমাত্র ফ্রিল্যান্সিং সাইট নির্ভর না হয়ে নিজের বিজনেসের পেছনে ইফোর্ট দিলে সেটা লং-টার্মে সাকসেস এনে দিতে একশোভাগ ইফেকটিভ হয়।
এটুকুই ছিলো আমাদের আজকের ডিসকাশন। আমি সব ফ্রিল্যান্সারকে এটাই বলতে চাই, ফ্রিল্যান্সিং সাইট ক্যারিয়ারের শুরুর জন্য কাজ করার মাধ্যম হিসেবে ঠিক থাকলেও কখনোই এটার ওপর পুরোপুরিভাবে নির্ভর করবেননা। বরং সবসময় চেষ্টা করবেন মার্কেটপ্লেসের বাইরে কিভাবে নিজের বিজনেস ডেভেলপ করা যায়। তাহলেই দেখবেন সময় লাগলেও ধীরে ধীরে একটা স্ট্যাবল এবং সাকসেসফুল অবস্থায় পৌঁছে যেতে পারবেন।
আমার একটা ফেসবুক গ্রুপ রয়েছে। এ গ্রুপের মেইন টার্গেট ফ্রিল্যান্সারদেরকে নিজের বিজনেস ডেভেলপ করার জন্য প্রয়োজনীয় গাইডলাইন দেয়া। পাশাপাশি এ গ্রুপে পেয়ে যাবেন ফ্রিল্যান্সিং রিলেটেড বিভিন্ন রিসোর্স। তাই আমার আর্টিকেলটা ভালো লাগলে গ্রুপে জয়েন দিতে ভুলবেননা!