সফল হওয়ার উপায় জেনে তা নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে চান প্রত্যেকেই। কিন্তু আমাদের এই সফল হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এমন কিছু অভ্যাস, যেগুলো আপাতদৃষ্টিতে সেভাবে ক্ষতিকর মনে না হলেও আমাদের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। Procrastination বা কোনো কাজে অকারণে বিলম্ব করা এমনই একটি অভ্যাস। আপনি একজন শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী কিংবা ফ্রিল্যান্সার যা ই হয়ে থাকুন না কেন, প্রোক্যাসটিনেট করার অভ্যাস থাকলে তা আপনার প্রোডাক্টিভিটি ও কাজের প্রতি মোটিভেশন দুটিতেই ইমপ্যাক্ট ফেলবে। বিশেষ করে ফ্রিল্যান্সারদের জন্য এই অভ্যাসটি খুবই ক্ষতিকর। আজকের লেখায় বিস্তারিতভাবে জানাবো কোন ট্রিকগুলো ফলো করলে প্রোক্যাসটিনেশন করার হ্যাবিট কিছুটা হলেও কন্ট্রোল করা সম্ভব হবে।
প্রোক্যাসটিনেশন সম্পর্কে জানেন কী?
Procrastination বলতে নিজের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো না করে বিলম্ব বা দেরি করাকে বোঝানো হয়। আরেকটু স্পেসিফিক করে বলতে গেলে, কোনো কাজ লাস্ট মিনিটের জন্য বা ডেডলাইনের শেষ প্রান্তে গিয়ে করার জন্য জমিয়ে রাখাটাই প্রোক্যাসটিনেশন। বিভিন্ন কারণে এই হ্যাবিট মানুষের মধ্যে গ্রো করতে পারে। ফ্রিল্যান্সারদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কাজের চাপ, স্ট্রেস, ক্লান্তি ইত্যাদি কারণে প্রোক্যাসটিনেট করার টেন্ডেন্সি তৈরি হয়।
প্রোক্যাসটিনেট করা কতটা ক্ষতিকর?
প্রোক্যাসটিনেশনকে প্রোডাক্টিভিটি কিলার বলা হয়। প্রতিটি কাজ শেষ সময়ে করার জন্য ফেলে রাখতে রাখতে মানুষের মধ্যে অলসতা তৈরি হয়, যা তাদের প্রোডাক্টিভিটি কমিয়ে দেয় অনেকগুণ। শুধু তাই নয়, এই অভ্যাস থাকলে ধীরে ধীরে কাজের প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়। তখন বারবার মনে হতে থাকে, “কাজ না করে বরং একটু ব্রেক নেওয়া যাক।” এভাবে ব্রেক নিতে নিতে দেখা যায় কাজটি কমপ্লিট করার সময় এসে গেছে ঠিকই, কিন্তু কাজের ফিফটি পারসেন্টও কমপ্লিট হয়নি! এতে করে তখন বাড়তি একটা স্ট্রেস তৈরি হয়, যা থেকেও কাজের স্পিড ও কোয়ালিটিতে ইমপ্যাক্ট পড়ে।
বিষয়টা উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করি। ধরা যাক, “ক” একজন ফ্রিল্যান্সার। তাকে আগামী ৫ দিনের মধ্যে ক্লায়েন্টকে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট ডেলিভারি করতে হবে। যেহেতু এই প্রজেক্টটা কিছুটা জটিল, তাই সময়মতো ডেলিভারি দিতে চাইলে স্বাভাবিকভাবেই তাকে আগে থেকে কাজ শুরু করতে হবে। কিন্তু হঠাৎ করে “ক” এর মনে হতে থাকলো, “আরেহ ৫ দিন সময় তো আছেই, আস্তে ধীরে সব কাজ কমপ্লিট করে ফেলবো।” এখানে সে কিন্তু বুঝতে পারছে তার সময় নষ্ট করা ঠিক হচ্ছে না এবং দ্রুত কাজে হাত দেওয়া উচিত। তাও সে সময় নষ্ট করলো এবং পুরো ৩ দিন পার করার পর বুঝতে পারলো হাতে একদমই সময় নেই। তারপর সে কোনো মতে প্রজেক্ট কমপ্লিট করে ক্লায়েন্টকে ডেলিভারি করলো ঠিকই, কিন্তু তারপর দেখা গেলো কাজে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা ডিটেইল মিসিং আছে, আবার টুকটাক ভুলও আছে। এতে করে ক্লায়েন্টের সামনে তার ইম্প্রেশন তো ডাউন হবেই, ওই ক্লায়েন্ট ফিউচারে হয়তো তার সাথে আর কাজ করতে আগ্রহী হবেন না।
খেয়াল করে দেখুন, যদি “ক” এই প্রজেক্ট ডেলিভার করার জন্য যে ৫ দিন সময় পেয়েছিলো, সেই সময়টা নষ্ট না করে ফুল কনসেনট্রেশনে কাজ করতো, তাহলে কিন্তু তাকে তাড়াহুড়ো করে কাজ শেষ করতে হতো না এবং তার কাজে ভুল হতো না। তখন সে একজন ভ্যালুয়েবল আইডিয়াল ক্লায়েন্টও হারাতো না।
শুধু “ক” ই নয়, কাজে প্রোক্যাসটিনেট করার জন্য এমন আরো অনেক ফ্রিল্যান্সারই সাফার করেন। এমনকি অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা যথেষ্ট স্কিলড ও এক্সপেরিয়েন্সড, কিন্তু প্রোক্যাসটিনেট করার হ্যাবিট আছে দেখে তারা হাই পেয়িং ক্লায়েন্টদের সময়মতো রিচ আউট করেন না, আবার ক্লায়েন্ট পেলেও তাদেরকে সময়মতো প্রজেক্ট ডেলিভারি করতে পারেন না। এতে করে যথেষ্ট পটেনশিয়াল থাকার পরেও তাদের ক্যারিয়ার সেভাবে গ্রো করে না। সুতরাং নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, এই অভ্যাস দূর করা কতটা জরুরি।
কীভাবে এই অভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করবেন?
প্রোক্যাসটিনেশন কন্ট্রোল করা কিন্তু খুব বেশি কঠিন নয়। কিছু বিষয় মেনে চললে আপনারাও এই অভ্যাস থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন। চলুন দেরি না করে সেগুলো সম্পর্কে জেনে আসা যাক –
কাজের মাঝে ব্রেক নিন
সত্যি বলতে প্রোক্যাসটিনেশন এমন একটি হ্যাবিট যা কন্ট্রোল করার জন্য নিজেকেই সবার আগে সচেতন হতে হবে। অনেকে আছেন যারা স্বীকারই করতে চান না যে তারা প্রোক্যাসটিনেট করছেন। তারা দাবি করেন, তারা নাকি কাজের মাঝে ব্রেক নিচ্ছেন। একটা বিষয় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, ব্রেক নেওয়া আর প্রোক্যাসটিনেট করা পুরোপুরি আলাদা বিষয়।
একজন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে আপনার কাজের কোয়ালিটি আপ টু দ্যা মার্ক রাখার জন্য কাজের মাঝে ব্রেক নিতেই হবে। সেক্ষেত্রে প্রতি দুই থেকে তিন ঘন্টা পর পর ২০-৩০ মিনিটের ব্রেক নিন। কাজের মাঝে খুব লম্বা ব্রেক নেওয়া যাবে না, কারণ এতে করে কাজের স্পিড কমে যায়। ক্লায়েন্টের ডেডলাইন থাকলে কখনোই একবারে কাজ না করে, লাস্ট মিনিটে শেষ করার আশায় সেটি ফেলে রাখবেন না। তার চাইতে ছোট ছোট ব্রেক নিয়ে কাজ করুন, দেখবেন টায়ার্ডনেস কমে আসবে, স্ট্রেসড ফিল হবে না, আবার টাইমলি ডেলিভারিও করতে পারবেন।
দিনের শুরুতেই কঠিন টাস্কগুলো কমপ্লিট করুন
সাধারণত দেখা যায়, ফ্রিল্যান্সাররা ডিফিকাল্ট বা টাইম কনজিউমিং প্রজেক্টগুলোর ক্ষেত্রেই বেশি প্রোক্যাসটিনেট করে থাকেন। রিয়েল লাইফ এক্সপেরিয়েন্স থেকে একটা সল্যুশন দেই। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সকালবেলা আমাদের প্রোডাক্টিভিটি সবচেয়ে বেশি থাকে এবং ব্রেইন সবচেয়ে ভালোভাবে ফাংশন করে। তাই যদি এই ধরনের কাজগুলো দিনের শুরুতে করে ফেলা যায়, তাহলে দেখা যায় কাজে বেশি ফোকাস করা যায় এবং সেভাবে ভুলও হয় না। আবার কাজ শেষে মেন্টালি রিলিফড ফিল হয় এবং দেখা যায় বাকি টাস্কগুলো শেষ করতে আর ডিমোটিভেটেড ফিল হয় না। তাই যদি কোনো বড় প্রজেক্টের ডেডলাইন থাকে অথবা ডিটেইল অরিয়েন্টেড ক্রিটিকাল কোন প্রজেক্ট হয়, তাহলে দিনের শুরুতে সেই প্রজেক্টের কাজই শুরু করুন।
প্রায়োরিটি বুঝে টু-ডু লিস্ট তৈরি করুন
ফ্রিল্যান্সারদের কাজের ট্র্যাক রাখতে টু-ডু লিস্ট কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। যদি আপনার সব কাজ লাস্ট মিনিটের জন্য জমিয়ে রাখার অভ্যাস থেকে থাকে, তাহলে টু-ডু লিস্ট তৈরি করার সময় র্যানডমলি কাজের লিস্ট না করে যে কাজগুলো আগে শেষ করা প্রয়োজন সেগুলো আগে লিখুন, অর্থাৎ প্রায়োরিটি বুঝে টু-ডু লিস্ট তৈরি করার চেষ্টা করুন। এতে করে গুরুত্বপূর্ণ টাস্কগুলো কমপ্লিট করার ব্যাপারটা আপনার ব্রেইনে সেট হয়ে যাবে এবং দেখবেন প্রোক্যাসটিনেট করার ইচ্ছা ধীরে ধীরে কমে আসবে।
অ্যাকাউন্টেবিলিটি পার্টনারের হেল্প নিন
অ্যাকাউন্টেবিলিটি পার্টনার এমন একজন মানুষ যিনি আপনার কাজের ট্র্যাক রাখতে আপনাকে হেল্প করতে পারবেন। যদিও আমাদের দেশের ফ্রিল্যান্সারদের মধ্যে এই প্র্যাকটিস সেভাবে নেই, কিন্তু অ্যাকাউন্টেবিলিটি পার্টনার থাকলে তার কাছে নিজের কাজের আপডেট দেওয়ার বিষয় থাকে বলে দেখা যায় প্রোক্যাসটিনেট করার সুযোগ সেভাবে পাওয়া যায় না। বরং সঠিক অ্যাকাউন্টেবিলিটি পার্টনারের সাথে রেগুলার কমিউনিকেট করার ফলে একজন ফ্রিল্যান্সারের প্রোডাক্টিভিটি বাড়ে এবং ক্যারিয়ারে গ্রো করা পসিবল হয়।
ডিসট্র্যাকশন থেকে দূরে থাকুন
বর্তমান সময়ে ফ্রিল্যান্সারদের মধ্যে প্রোক্যাসটিনেট করার প্র্যাকটিস এত বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো ডিসট্র্যাকশন। কাজের মাঝে সোশ্যাল মিডিয়া ব্রাউজ করা, পছন্দের মুভি বা সিরিজ দেখতে বসে যাওয়া কিংবা গেইম খেলা – এই ডিসট্র্যাকশনগুলোর জন্য প্রোক্যাসটিনেট করা টেন্ডেন্সি বেড়ে যেতে থাকে। তাই কাজের সময় ফোকাস শুধুমাত্র কাজের দিকে করুন। তারপর যখন ব্রেক নিবেন, তখন সোশ্যাল মিডিয়াতে ঢুঁ মারতে পারেন কিংবা প্রিয় গেম কিছু সময় ধরে খেলতে পারেন।
আশা করি আপনারা এখন বুঝতে পারছেন, ডেইলি লাইফে কয়েকটা ছোটখাটো চেঞ্জ আনার মাধ্যমেই প্রোক্যাসটিনেশন কন্ট্রোলে আনা পসিবল। সবার ক্যারিয়ারের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইলো। এমন আরো হেল্পফুল পোস্ট পেতে আমাদের সাথেই থাকুন।